জেলা শেরপুরের ভেতর দিয়ে বুক চিরে বয়ে চলা যমুনার শাখা নদী দশানী ও ব্রহ্মপুত্র নদের শাখা নদীর মিলনস্থল সদর উপজেলার কামারেরচর ইউনিয়নের ৬নং চর এলাকায়। এই জায়গাটিতে মাঝে মাঝে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হওয়ায় এলাকাটিই এখন মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে।প্রত্যেক বছরের ন্যায় এবারও টানা বর্ষণে শেরপুর জেলায় ব্রহ্মপুত্র ও দশানী নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্ষার শুরুতেই এসব নদীর ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনে বাড়ি-ঘর, আবাদি জমি ও রাস্তাঘাট নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে।বিগত দুই বছরে দশানী নদীর ভাঙনে কামারেরচর ইউনিয়নের ৬নং চর গ্রামের অনেক পরিবারের বসতভিটা, কবরস্থানসহ আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। সমপরিমাণ ক্ষতির মুখে পড়েছে ৭নং চরের মানুষ। অনেকের জায়গা-জমি নদীতে বিলীন হওয়ায় মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। গত বছর পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে কিছু জিও ব্যাগ ফেলেই দায় মুক্তির চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু মেলেনি স্থায়ী সমাধান। এলাকাবাসীরা এই নিয়ে বার বার ক্ষোভ প্রকাশ করে জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় প্রশাসনকে জানিয়েও কাজ হয়নি। এবারও দায়সারা পুরোনো আশ্বাসই দিয়ে যাচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে স্থানীয়দের দাবি, পাইলিং করে তৈরি করা হোক স্থায়ী সমাধান।গতকাল ৪ জুলাই (বৃহস্পতিবার) দুপুরে ৬নং এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মৌসুমের শুরুতেই ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে গত তিন দিনেই প্রায় দেড়শ মিটার এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে নদীর গর্ভে বিলীন হয়েছে অন্তত ত্রিশ থেকে চল্লিশটি বাড়ি। একর একর আবাদি জমির সঙ্গে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে সবজির বাগান ও ধানের বীজতলা। এমনকি ভাঙনের মুখে পড়েছে ৬নং চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ ও দুটি মাদ্রাসা, পোস্ট অফিস, গ্রামের রাস্তা ও কবরস্থান। আতঙ্কের মধ্যে দিনাতিপাত করছে মানুষ। অনেকেই শঙ্কায় আছেন, কখন তাদের বাড়িঘর ও জমি নদীগর্ভে চলে যায়।স্থানীয়দের উদ্যোগে নির্মিত অস্থায়ী কাঠের পুল ভেঙে যাওয়ায় এখন চরম ভোগান্তিতে ১০ হাজার মানুষ,অপরদিকে ৭নং চর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, গতবারের দেওয়া জিওব্যাগ ফেলা অংশে ভাঙন শুরু না হলেও তার আগে ও পরের এলাকায় শুরু হয়েছে ভাঙন। এতে চরম হুমকির মুখে রয়েছে এলাকার একমাত্র বাজার। এলাকার অধিকাংশ নদী তীরবর্তী মানুষের বাড়ি ৭ থেকে ৮ বার স্থান পরিবর্তন করেও মিলছে না প্রতিকার। স্থানীয় বালু ব্যাবসায়ীদের বালি উত্তোলন ও অপরিকল্পিত নদী খননের ফলকেও এর কারণ হিসেবে দায়ী করছেন স্থানীয়রা।স্থানীয় এক বৃদ্ধ কৃষক লুৎফর রহমান বলেন, আমাদের চার ভাইয়ের মোট ৬০ বিঘা জমি ছিল। সর্বনাশা নদী আমাদের সব কেড়ে নিয়েছে। খুব কষ্টের মধ্যে আমাদের জীবন কাটছে।জলিল মিয়া নামের স্থানীয় আরেক যুবকের ভাষ্যমতে, এখন পর্যন্ত আমরা মোট সাতবার বাড়ি স্থানান্তর করেছি, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি এবারো আবার ভাঙনের কবলে পড়েছি। এবার নতুন করে ঘর তোলার মতো আর নিজের জায়গা নেই। প্রতিবেশীর জায়গাতে বাড়ি করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। কামারেরচর ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য সাইফুদ্দিন মণ্ডল আক্ষেপ করে জানান, এই নদীতে দুই বছর আগে আমার বাড়ি ভেঙে গেছে। অন্যের জমিতে বাড়ি করে আছি। এবারও আমার নতুন বাড়ির অর্ধেক ভেঙে গেছে। আমি এখন ভূমিহীন হয়ে গেছি। এই নদীর ভাঙন রোধ না করতে পারলে আমার মতো শত শত লোক ভূমিহীন হয়ে যাবে।এ বিষয়ে কামারেরচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব হাবিবুর রহমান বলেন, নদীর গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে। একেকবার একেক এলাকায় তাণ্ডব চালাচ্ছে নদী। গত বছর ভাঙন শুরু হলে প্রশাসনের লোকজন এনে পরিদর্শন করিয়েছি। পরে দুই জায়গায় ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। এবার আবারও ভাঙন শুরু হয়েছে। এরইমধ্যে আমি ইউএনও ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানিয়েছি। আশাকরি দ্রুত সময়ের মধ্যে হয়তো ব্যবস্থা নেবে তারা।এ বিষয়ে শেরপুর জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নকিবুজ্জামান খান বলেন, শেরপুরের বেশ কয়েকটি নদীর ভাঙন দেখা দিয়েছে। আমরা নদী ভাঙন এলাকার খোঁজ নিচ্ছি। বিষয়টি আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করেছি। ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।