নাফ নদীর ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের নাকপুরা গ্রাম। যেখানে রাতভর চলে গোলাগুলি ও মর্টারশেলের বিস্ফোরণ।
বাংলাদেশের সীমান্তঘেষা মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যের জেলা শহর মংডুর দুই পাশের (উত্তর ও দক্ষিণ) কয়েকটি গ্রামে গতকাল শনিবার সন্ধ্যা থেকে আজ রোববার ভোর পাঁচটা পর্যন্ত সারা রাত থেমে থেমে গোলাগুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে।
মর্টার শেলের বিস্ফোরণের বিকট শব্দে নাফ নদীর এপারে কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সাবরাং, টেকনাফ পৌর শহর, হ্নীলা ও হোয়াইক্যং ইউনিয়নে কম্পন অনুভূত হয়। আতঙ্কে রাত কেটেছে গ্রামগুলোর অন্তত ১০ হাজার মানুষের।
তবে কক্সবাজারের উখিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে আজ রোববার সকাল আটটা পর্যন্ত গোলাগুলির কোন শব্দ শুনতে পাননি স্থানীয় লোকজন।
কক্সবাজার টেকনাফের চারটি ইউনিয়ন হোয়াইক্যং, হ্নীলা, টেকনাফ সদর ও সাবরাং এবং উখিয়ার পালংখালীর বিপরীতে নাফ নদীর ওপারে শত কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের রাখাইন রাজ্য। উত্তর-দক্ষিণ লম্বা রাখাইন রাজ্যের মধ্যভাগে (টেকনাফ পৌর শহরের বিপরীতে) মংডু টাউনশিপের অবস্থান। মংডুর পশ্চিমে নাফ নদী, পেছনে আকাশছোঁয়া কালাদান পাহাড়। তিন দিন ধরে মংডু শহরের উত্তর দিকের কুমিরখালি, নাইচাডং, কোয়াচিদং, শিলখালী, বলিবাজার, কেয়ারিপ্রাং, পেরাংপ্রু গ্রামে গোলাগুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে। সেখানে সীমান্তচৌকি দখল এবং পুনরুদ্ধার নিয়ে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে জড়ায় দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি।
নাফ নদীর তীরে টেকনাফের নেটং পাহাড়ের নিচে ছোট্ট ঘরে সপরিবার থাকেন স্থানীয় গাড়িচালক আলী আহমদ। গভীর রাতে যখন ওপারে বিকট শব্দে মর্টার শেলের বিস্ফোরণ ঘটে, তখন তিনি নদীর তীরে এসে দাঁড়ান। দেখতে পান ওপারে আগুনের ফুলকি, আকাশে কালো ধোঁয়া। তিনি বলেন, তিন দিন ধরে মংডু শহরের উত্তরের কয়েকটি গ্রামে সবচেয়ে বেশি মর্টার শেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হচ্ছে। তবে মর্টার শেল কারা নিক্ষেপ করে তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন।
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের লোকজনদের ভাষ্য অনুযায়ী গত কিছুদিন মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ভারি গোলাগুলি, মর্টার শেল নিক্ষেপ বন্ধ থাকার পর পুনরায় গত বৃহস্পতিবার সকাল নয়টা থেকে নতুন করে শুরু হয় গোলাগুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপ। তবে দিনের চেয়ে রাতে যুদ্ধের তীব্রতা বাড়ে অনেক। তখন আকাশপথে হামলার পাশাপাশি ছোড়া হয় মর্টার শেল। মর্টার শেলের বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে টেকনাফ সীমান্ত। নাফ নদীর টেকনাফ অংশ সবুজ প্যারাবনে ঢাকা। প্যারাবন ও নাফ নদীতে নেমে স্থানীয় বাংলাদেশি লোকজন মাছ-কাঁকড়া আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করলেও রাখাইন পরিস্থিতিতে তা বন্ধ রয়েছে।
টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রাশেদ মোহাম্মদ আলী বলেন, মংডুর রাচিডং-বুচিডং টাউনশিপেও সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির তুমুল সংঘর্ষের খবর পাওয়া যাচ্ছে। আরাকান আর্মি মংডু শহরকে তিন দিক থেকে ঘিরে হামলা চালাচ্ছে। রাখাইন রাজ্যের পশ্চিম দিকের নাফ নদী অংশের নিয়ন্ত্রণ এখনো সরকারি বাহিনীর হাতে আছে।
মিয়ানমার থেকে আগত টেকনাফ স্থলবন্দরে আমদানি পণ্য নিয়ে আসা কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, কয়েক দিন ধরে রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিথুয়েতেও (আকিয়াব) দুই পক্ষের লড়াই তীব্র আকার ধারণ করেছে। দেশটির রাজধানী ইয়াঙ্গুনের সঙ্গে সিথুয়ের যাতায়াতের সড়কটির কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলেছে আরাকান আর্মি। সেখানকার পোন্নাগিউনে পুলিশের একটি ফাঁড়ি দখল করে নিয়েছে তারা। আরাকান আর্মি সিথুয়ে ও মংডু শহরের নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
কক্সবাজার জেলার টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, গতকাল শনিবার সন্ধ্যা থেকে আজ রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত মংডুর আশপাশের কয়েকটি গ্রামে ২০-২৫টি মর্টার শেলের বিস্ফোরণ ঘটে। তাতে টেকনাফ পৌরসভার জালিয়াপাড়া, চৌধুরীপাড়া, কুলালপাড়া, ডেইলপাড়াতে কম্পন দেখা দেয়।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, মংডুর আশপাশের গ্রামে গোলাগুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটলেও আজ সকাল পর্যন্ত টেকনাফ সীমান্তে গুলি এসে পড়ার খবর পাওয়া যায়নি। সীমান্ত এলাকার লোকজনকে নিরাপদ দূরত্বে সতর্ক অবস্থায় থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে নাইক্ষ্যংছড়ির ধুমধুম ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, আজ সকাল সাতটা পর্যন্ত টানা চার দিন ঘুমধুম সীমান্তের মানুষ গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাননি। এখন যেখানে যুদ্ধ চলছে, তা ঘুমধুম সীমান্ত থেকে ৫০-৬০ কিলোমিটার দূরে। উখিয়ার পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আরাকান আর্মি মংডু টাউনশিপের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ দিক ঘিরে রেখেছে। এখন তারা মংডু শহরের নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া। অন্যদিকে সরকারি বাহিনীও আরকান আর্মিকে রুখতে সর্বশক্তি নিয়োগ করছে। তাতে পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল আকার ধারণ করছে।
টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফ নদী ও সীমান্তে বিজিবির টহল বাড়ানো হয়েছে।