অতি ভারী বৃষ্টি ও ভারত থেকে আসা ঢলের পানিতে ফেনীর পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। উপজেলাগুলোতে নৌকার অভাব ও তীব্র স্রোতে উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এতে মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে এসব এলাকার লাখো মানুষ। আজ বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ইতিমধ্যে ফুলগাজী পরশুরামের সব এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দেড় মাসের ব্যবধানে তৃতীয় দফায় ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে ফেনীর পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ। গত কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টি ও ভারতের উজানের পানিতে গত সোমবার দুপুর থেকে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের ভাঙন স্থান দিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করতে শুরু করে। এতে তিন উপজেলার রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও মাছের ঘের পানিতে তলিয়ে গেছে।
লোকালয়ে পানি ঢুকে শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক সড়ক ও উপজেলার অভ্যন্তরীণ সড়কে বন্ধ রয়েছে যান চলাচল। লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বিদ্যুৎ সংযোগ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফুলগাজী উপজেলার সদর ইউনিয়ন, আনন্দপুর, মুন্সীরহাট, আমজাদহাট ইউনিয়নের ৪০টির বেশি গ্রাম ও পরশুরাম উপজেলার মির্জানগর, চিথলিয়া, বক্সমাহমুদ ও পৌর শহরসহ ৪৫টির বেশি গ্রাম পানিতে তলিয়ে রয়েছে। ছাগলনাইয়ার পাঠাননগর, রাধানগর, শুভপুর ইউনিয়নসহ তলিয়ে গেছে পুরো উপজেলার রাস্তাঘাট, পুকুর ও ফসলি জমি। কিছু কিছু এলাকায় মানুষের ঘরের ছাদ ও টিনের চালেও ছুঁয়েছে বন্যার পানি। এমন পরিস্থিতিতে আশ্রয় খুঁজছে স্থানীয়রা। বন্যাদুর্গতদের জন্য ত্রাণসহায়তা নিয়ে মাঠে নেমেছেন স্থানীয় প্রশাসন ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
পরশুরামের সলিয়া এলাকার বাসিন্দা হাবিব স্বপন বলেন, ‘আমাদের ত্রাণের চেয়েও এখন নৌকা বা স্পিডবোট বেশি প্রয়োজন। বন্যা পরিস্থিতি এমন হবে, কেউ বুঝতে পারেনি। অনেকে রাত থেকে উদ্ধার করতে আসতেছে বললেও তেমন কাউকে দেখা যায়নি। সোমবার রাত থেকে বিদ্যুৎ নেই, বন্যার সঙ্গে বিদ্যুৎ, মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় অনেক বেশি ভোগান্তি দেখা দিয়েছে।’
ছাগলনাইয়ার বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম বাবলা বলেন, ‘রাত ২টার দিকে বুক সমান পানি দিয়ে ছোট দুই সন্তানকে মাথায় নিয়ে পরিবারসহ অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। চারদিকে পানি থইথই করছে। ঘরবাড়ি সব ডুবে গেছে। জিনিসপত্র কোনো কিছুই বের করতে পারিনি।’
কিসমত ঘনিয়ামোড়া এলাকার বাসিন্দা লোকমান হোসেন বলেন, ‘ঘরের ছাদ পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে গেছে। মানুষদের উদ্ধারে দু-একটি নৌকা কাজ করলেও পানির স্রোতের কারণে সম্ভব হচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা বেশি প্রয়োজন। দুই দিন ধরে বিদ্যুৎ, মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় আরও কষ্ট করতে হচ্ছে। এ ছাড়া ভারতের ত্রিপুরায় ডম্বুর গেট খুলে দেওয়া হয়েছে বলে জেনেছি। এতে এদিকে পানির চাপ আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (অ. দা.) মো. আবুল কাশেম বলেন, মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার ৮৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এত পানি আগে কখনো দেখা যায়নি। মানুষকে উদ্ধারেও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। আমরা অসহায় হয়ে গেছি। পরিস্থিতি খুবই খারাপ। এখনো বৃষ্টির সঙ্গে পানি বাড়ছে।’
ফেনীতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, পানিবন্দীদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও কোস্ট গার্ডফেনীতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, পানিবন্দীদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও কোস্ট গার্ড পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আফরোজা হাবিব শাপলা বলেন, ‘উপজেলার চিথলিয়া, সলিয়া ও অলকা এলাকায় অনেক মানুষ আটকা পড়েছে। রাত থেকে ফায়ার সার্ভিস ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে উদ্ধারকাজ চলছে। কিন্তু নৌকার সংকট রয়েছে। পানির স্রোতের জন্য ঠিকভাবে কাজ করা যাচ্ছে না। এ মুহূর্তে স্পিডবোটের প্রয়োজন। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।’
ফুলগাজীর ইউএনও তানিয়া ভূঁইয়া বলেন, ‘স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ এ বন্যায় উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের প্রায় অধিকাংশ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে, পানিবন্দী হয়ে পড়েছে অসংখ্য মানুষ। গতকাল মঙ্গলবার থেকে ফায়ার সার্ভিসের সদস্য এবং স্বেচ্ছাসেবক-ছাত্রদের সহায়তায় দুটা ডিঙি দিয়ে লোকজনকে উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’
ইউএনও তানিয়া ভূঁইয়া আরও বলেন, এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০০ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। ইতিমধ্যে সেনাবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের সহায়তায় উদ্ধারকাজ শুরু করা হয়েছে। একজনও মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গিয়েছে। পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ এবং আরও ৫০০ প্যাকেট শুকনো খাবার ও ১৮ টন চাল প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
ফেনীর ৪-বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল শেখ মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন জানান, সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে বিজিবি নৌকা ও ট্রলারের মাধ্যমে পানিবন্দী মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়স্থানে পৌঁছে দিচ্ছে। এর পাশাপাশি উদ্ধার করা জনসাধারণের মাঝে বিশুদ্ধ খাবার পানি ও জরুরি শুকনো খাবারও বিতরণ করছে।
ফেনী আবহাওয়া অধিদপ্তরের উচ্চ পর্যবেক্ষক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, ফেনীতে টানা তিন দিন মাঝারি ও ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। জেলায় আজ সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৯৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আগামী ৭২ ঘণ্টা বৃষ্টি অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ বিষয়ে ফেনী জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার বলেন, সেনাবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের একটি টিম স্পিডবোট নিয়ে দ্রুতই বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে যাবে। জেলা শহর থেকে নদীপথ না থাকায় পরিবহনে করে স্পিডবোট নিতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। এ ছাড়া সীমান্ত এলাকায় স্থানীয় বিজিবি সদস্যরা উদ্ধারে কাজ করছেন।