বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) নিবন্ধিত নিয়োগবঞ্চিত শিক্ষক ফোরাম এই অভিযোগ করেছে। সারাদেশে ৬০ হাজার শিক্ষক জাল সনদে চাকরি করছেন।
এই বিষয়ে তথ্য উপাত্ত ঘাঁটাঘাঁটি করে জানা, ২০১৪-১৫ অর্থবছরের হিসাব মতে, সারাদেশে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক স্তরের চিহ্নিত প্রায় ৬০ হাজার শিক্ষক এখন জাল সনদে শিক্ষকতা করছেন। তারা সরকারের ‘মান্থলি পে-অর্ডার’ বা এমপিও পেয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কোটি কোটি টাকা বেতন-ভাতা তুলে নিচ্ছেন। কেবল চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ২৬৮ শিক্ষকের সনদ জাল বলে তদন্তকালে ধরা পড়েছে। ভুয়া সনদধারী শিক্ষকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে এমন উদ্বেগ প্রকাশ করে তাদের কাছ থেকে টাকা ফেরত নেওয়ার সুপারিশ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এক তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে ডিআইএ।
সেই সময়, ডিআইএর পরিচালক অধ্যাপক মো. মফিজ উদ্দিন আহমদ ভূঁইয়া জনপ্রিয় নিউজ পত্রিকা দৈনিক সমকালকে বলেছিলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৭ মে পর্যন্ত তদন্তকালে ২৬৮ শিক্ষকের সনদ জাল বলে তারা প্রমাণ পেয়েছেন। তাদের কাছ থেকে আট কোটি ৫৪ লাখ ৩৪ হাজার ৩১ টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। তিনি জানান, এই ২৬৮ জনের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৮২ জন জাল সনদধারী শিক্ষক বেতন-ভাতা তুলেছেন দুই কোটি ২৯ লাখ ২১ হাজার ৬৯৭ টাকা। এভাবে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের ১১ শিক্ষক ৪৭ লাখ ৭১ হাজার টাকা, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১০৯ শিক্ষক তিন কোটি ৩৬ লাখ ৯৯ হাজার টাকা এবং খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ৬৬ শিক্ষক দুই কোটি ৪০ লাখ ৪১ হাজার টাকা তুলে নিয়েছেন।
২০১৪-১৫ অর্থ বছরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া ডিআইএর প্রতিবেদনে দেখা যায়, কেবল এক বছরে (গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত) সারাদেশে এক হাজার ৫১৮ শিক্ষকের সনদ জাল বলে প্রমাণিত হয়েছে। এই এক হাজার ৫১৮ শিক্ষক ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন-ভাতা বাবদ তুলেছেন ৭৩ কোটি ৪৭ লাখ ৮৫ হাজার ৪৭৭ টাকা। ডিআইএ এই টাকা ওই শিক্ষকদের কাছ থেকে আদায় করার জন্য সুপারিশ করেছে। অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমদ ভূঁইয়া এ প্রসঙ্গে সমকালকে বলেন, এসব শিক্ষক তদন্তকালে চিহ্নিত হয়েছেন। জনবল সংকট ও সামর্থ্যের কারণে সব প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে সরেজমিনে তদন্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি জানান, তার ধারণা তদন্তের বাইরে থাকা জাল সনদধারী শিক্ষকের প্রকৃত সংখ্যা অন্তত ৪০ গুণ বেশি হবে। সে হিসাবে সারাদেশে এ মুহূর্তে জাল সনদধারী শিক্ষকের সংখ্যা ৬০ হাজারের বেশি।
এই থেকে বুঝা যায়, জাল সনদের এ ব্যবহার শিক্ষকদের ক্ষেত্রে নতুন কিছু নয়। ডিআইএর নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ১৯৮১ সাল থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ৪৪ বছরে সারাদেশে ৫১ হাজার ৯৯২ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে প্রায় সারে চার লাখ শিক্ষকের সনদ জাল বলে চিহ্নিত করেছে ডিআইএ।
এসব শিক্ষক এই সময়কালে সরকারি কোষাগার থেকে প্রায় ৮’শত কোটি টাকা বেতন-ভাতা তুলেছেন। ডিআইএ বলছে, সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূতভাবে অবৈধ উপায়েও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে এসব শিক্ষক সরকারি বেতন তুলেছেন। তাদের কাছ থেকে সমুদয় টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত আনতে হবে।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শিক্ষকরা মূলত চার ধরনের জাল সনদ চাকরিতে বেশি ব্যবহার করছেন। ১. শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ, ২. নিবন্ধন সনদ, ৩. কম্পিউটার শিক্ষার ভুয়া সনদ এবং ৪. অভিজ্ঞতার জাল সনদ।
ভুয়া সনদধারীদের ধরেও ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে সংবাদ মাধ্যম জানতে চাইলে কথা বলতে রাজি হননি (২০১৪ সালের সমিক্ষা) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শাখা-১১-এর যুগ্ম সচিব অজিত কুমার ঘোষ। তবে একই শাখার সহকারী সচিব নূরজাহান বেগম বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আগের উইং প্রধান রফিকুজ্জামানের সময়ের সিদ্ধান্তের কারণে কম্পিউটার বিষয়ে জাল সনদধারীদের অনেককে ছাড় দেওয়া হয়েছে। তবে একাডেমিক ও এনটিআরসিএ সনদ জালকারীদের ছাড় দেওয়া হয় না। তিনি এ কথা বললেও সমকালের হাতে একাধিক নথি আছে, যাতে ছাড় পাওয়া শিক্ষকদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে।
তত্কালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সংবাদ মাধ্যমকে বলেছিলেন, জাল সনদধারীদের তিনি শিক্ষক বলতে চান না। তারা প্রতারক। প্রমাণিত হলে তাদের কঠোর শাস্তি পেতে হবে। মন্ত্রণালয়ের কেউ জাল সনদধারীদের অনৈতিক সুবিধা দিলে তিনি দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেবেন বলেও প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
নুরুল ইসলাম নাহিদ এর পরবর্তী শিক্ষামন্ত্রীরা মন্থর হয়ে পড়লে ডিআইএ কর্মকর্তারা বিভিন্ন মাধ্যমে এসব সমস্যা সমাধান করতেন।
এদিকে নিবন্ধিত নিয়োগবঞ্চিত শিক্ষক ফোরাম সোমবার সকাল থেকে এনটিআরসিএ’র কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেছেন মূলত প্রথম থেকে ১৫তম শিক্ষক নিবন্ধনের সনদ বাতিল নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত খবরকে কেন্দ্র করে।
তাদের দাবি, এনটিআরসিএ সচিব ওবায়দুর রহমান মন্তব্য করেছেন, ১-১৫তম পরীক্ষার মাধ্যমে যারা সনদ পেয়েছেন সেই সনদ বাতিল ও অকার্যকর এবং তাদের আর আবেদনের সুযোগ থাকবে না। কিন্তু মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে এনটিআরসিএ’র কাছ থেকে সনদ লাভ করেন তারা। ফলে অর্জিত সনদ বাতিল ও অকার্যকর করার ক্ষমতা কেউ রাখে না।
মানবন্ধনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, “আমরা পরিষ্কার করে বলতে চাই, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬ ও ১৭তমদের তিন বছরমেয়াদি সনদ থাকলেও ১ থেকে ১২তমদের সনদের নির্দিষ্ট কোনো মেয়াদ ছিল না।” আদালতের রায়ের কথা উল্লেখ করে তারা বলেন, ‘৫৪/২০২২ রিভিউ রায় এখনো ১ থেকে ১২তমদের পক্ষে এবং এই রায়ে বলা হয়েছে, ১২/০৬/২০১৮ সালে এমপিও নীতিমালার আগে যারা সনদ লাভ করেছে তাদের জন্য বয়স শিথিলযোগ্য। অর্থাৎ ২০১৮ সালের ১২ জুনের এমপিও নীতিমালার আগে যারা সনদ লাভ করেছে তাদের জন্য বয়স শিথিলযোগ্য। তাই এনটিআরসিএ সচিবের এই মন্তব্যের আমরা তীব্র প্রতিবাদ জানাই। এ ধরনের মন্তব্য আমাদেরকে মর্মাহত করার সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়ে রক্তক্ষরণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করেছে। আমরা অসহায় এবং নিরুপায় হয়ে পড়েছি। এনটিআরসিএ প্রতিনিয়তই আমাদের সঙ্গে প্রহসন করে চলেছে।’
এদিকে আন্দোলনের এক পর্যায়ে এনটিআরসিএ’র চেয়ারম্যান আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলেন। আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘এক থেকে ১৫তম শিক্ষক নিবন্ধনের সনদ বাতিলের খবর সম্পূর্ণ গুজব। গুজব এমন একটি ভয়ানক জিনিস যা আপনারা ফেসবুকে দেখেছেন, যেটা সঠিক নয়। তাই গুজবে কান দেবেন না।’